Wellcome to National Portal
Main Comtent Skiped

Title
When the sultana apa Reliable
Attachments

আব্দুল কুদ্দুস ও রুহুল বয়ান

১৪ জানুয়ারি ২০১৬, ০১:১২
আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৬, ০১:১২
প্রিন্ট সংস্করণ-দৈনিক প্রথম আলো
  
 

সুলতানা বেগমকে পথে পেলেই ঘিরে ধরেন মায়েরা। জানান সমস্যার কথা। প্রায় সময় পথেই রোগী দেখে পরামর্শ দেন। ১০ জানুয়ারি মাতারবাড়ীর সিকদারপাড়া থেকে তোলা ছবি l প্রথম আলোসুলতানা বেগমকে পথে পেলেই ঘিরে ধরেন মায়েরা। জানান সমস্যার কথা। প্রায় সময় পথেই রোগী দেখে পরামর্শ দেন। ১০ জানুয়ারি মাতারবাড়ীর সিকদারপাড়া থেকে তোলা ছবি l প্রথম আলোমহেশখালীর দ্বীপ ইউনিয়ন মাতারবাড়ী। ১০ বছর আগেও প্রত্যন্ত এই এলাকায় প্রসূতিসেবা ছিল না। কোনো নারীর প্রসব বেদনা মানেই পরিবারে আতঙ্ক। ট্রলার কিংবা অটোরিকশার খোঁজে শুরু হতো দৌড়ঝাঁপ।
গন্তব্য ট্রলারে চড়ে ১০০ কিলোমিটারের উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার; কিংবা অটোরিকশায় ২৬ কিলোমিটার দূরের পাশের উপজেলা চকরিয়ার হাসপাতাল-ক্লিনিক। কারণ, মহেশখালী উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও নেই প্রসূতিসেবা। শেষে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নবজাতক নিয়ে ফেরা। এতে খরচও অনেক। ফলে অনেকেই সেই পথে পা বাড়াতেন না। গ্রাম্য অদক্ষ ধাত্রীর ওপর মায়েদের ছেড়ে দিতেন পরিবারের সদস্যরা। প্রায় সময় ঘটত বিপদ—কখনো মায়ের, কখনো নবজাতকের। এটাই নিয়তি মেনে নিয়েছিল এখানকার মানুষ।
কিন্তু সেই নিয়তির ধারণা ভেঙে দিয়েছেন একজন নারী। তাঁর নাম সুলতানা বেগম। মাতাবাড়ীর মানুষের প্রিয় ‘সুলতানা আপা’। তিনি কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্রের পরিবার কল্যাণ সহকারী। সর্বশেষ গত এক বছরে তাঁর হাতে জন্ম নিয়েছে ৩৬৭টি শিশু। শুধ্ু সন্তান প্রসব নয়, প্রসূতি মা ও নবজাতককে সেবা দিয়ে চলেছেন নিরন্তর। নারীদের কর্মমুখী ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করতে সপ্তাহে তিন দিন ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে করেন মা সমাবেশ। চলে উঠান বৈঠকও। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় ও জেলা পর্যায়ের পুরস্কার।
প্রতি সপ্তাহে তিন দিন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে করেন মা  সমাবেশ l প্রথম আলোপ্রতি সপ্তাহে তিন দিন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে করেন মা সমাবেশ l প্রথম আলো২৪ ঘণ্টার সেবা! : সুলতানা বেগমের অফিস সময় সকাল নয়টা থেকে হলেও তিনি বেরিয়ে পড়েন সাতটায়। নিজেই মোটরসাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়ান এ বাড়ি–ও বাড়ি। খোঁজ নেন গর্ভবতী নারীদের। তাঁর মোটরসাইকেলের শব্দ শুনলেই ছুটে আসেন নারীরা। অনেকে পথেই পেয়ে যান সেবা। আবার বিকেল চারটায় অফিস শেষে ফেরার পথেও একই অবস্থা। আর মুঠোফোন খোলা থাকে সব সময়। ফোন পেলেই ছুটে যান প্রসূতির বাড়ি। এ জন্য নিজের টাকায় কিনেছেন মোটরসাইকেল। যত রাতই হোক, তিনি ছুটে যান। তাঁর জন্য কোনো বিপদ নেই। সবাই সহযোগিতা করেন তাঁকে। এভাবে সারাক্ষণই থাকেন রোগীদের নিয়ে।
১০ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে চারটার দিকে মাতারবাড়ী গিয়ে দেখা যায়, সিকদারপাড়া গ্রামে মোটরসাইকেল থামিয়ে এক নবজাতকের শরীর পরীক্ষা করছেন। পাশে দাঁড়ানো মা। পরামর্শ দিয়ে আবার ছুট। একটু যেতেই তাঁকে ঘিরে আবারও নারীদের জটলা। অতঃপর সমস্যার সামাধান। ঘরের কাছে বিনা মূল্যের সেবা পেয়ে গ্রামের মানুষও খুশি।
মাতারবাড়ী ইউনিয়নের সিকদারপাড়া, উত্তর সিকদারপাড়া, বান্ডি সিকদারপাড়া, বানিয়াকাটা এবং ওয়াপদাপাড়ায় তাঁর কর্ম এলাকা হলেও পাশের গ্রাম মগডেইল, মনহাজিরপাড়া ও তিতমাঝিরপাড়ার নারীদেরও সেবা দেন তিনি।
মগডেইল এলাকার ব্যবসায়ী তাজেম উদ্দিন জানান, ‘গত বছরের ৩১ অক্টোবর রাত তিনটায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর প্রসববেদনা শুরু হয়। এত রাতে স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় যাব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ মাথায় এল সুলতানা আপার কথা। মুঠোফোনে তাঁকে জানালাম। তিনি দ্রুত পরিবার কল্যাণকেন্দ্রে আসতে বললেন। ভোরে জন্ম নিল ছেলেসন্তান। তিনি না থাকলে যে কী হতো, বলে বোঝাতে পারব না।’
মনহাজিরপাড়ার বাসিন্দা দিনমজুর আবু তালেব বলেন, স্থানীয় ধাত্রীর মাধ্যমে সন্তান প্রসব করাতে গিয়ে জটিল পরিস্থিতিতে পড়েন তাঁর স্ত্রী। পরিবার কল্যাণকেন্দ্রে নেওয়ার পর কয়েক মিনিটের মাথায় সুলতানা আপা ছেলে কোলে তুলে দিয়ে বললেন, ‘এই নেন আপনার ছেলে।’ তখন আনন্দে মনটা ভরে উঠেছিল।
তিতামাঝিরপাড়ার বাসিন্দা দুবাইপ্রবাসী মোহাম্মদ নুর হোসেন বলেন, কক্সবাজার শহরে কিংবা চকরিয়ায় হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা নিলে খরচ পড়ে সব মিলিয়ে ২০ হাজার টাকা। সুলতানা আপার হাতে সন্তান জন্ম নিলে এক টাকাও খরচ হয় না। উল্টো প্রসব–পরবর্তী সেবার জন্য পরিবার কল্যাণকেন্দ্র থেকে বিনা মূল্যে ওষুধপথ্য দেন।সুলতানা বেগমসুলতানা বেগম
সুলতানা বেগম বলেন, ‘সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রসূতি নারীরা কেন্দ্রমুখী হচ্ছেন। অবস্থা জটিল হলে আগেভাগে চকরিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য অনেকে কক্সবাজারও গেছেন।’ তিনি আরও বলেন, এই কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও ডেলিভারি টেবিল নেই। মাত্র একটি কাঠের টেবিলে প্রসূতি সেবা দিয়ে যাচ্ছি। একসঙ্গে চারজন প্রসূতি নারী এলে তাঁদের মেঝেতে বাচ্চা প্রসব করাতে হচ্ছে। এই কেন্দ্রে পর্যাপ্ত রক্ত ও অক্সিজেনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হলে প্রসূতির সংখ্যা বাড়বে।
মাতারবাড়ী পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক অছিউর রহমান জানান, এই এলাকার ৮০ হাজার মানুষের বসবাস। প্রতি মাসে অন্তত ৬০ জন নারী সন্তান প্রসব করেন। তার মধ্যে পরিবার কল্যাণকেন্দ্রে গিয়ে সন্তান প্রসব করেন গড়ে ৩৫ জন নারী। বাকি ২৫ জন বাইরে গিয়ে সেবা নেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ১০ শয্যায় উন্নীত করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি দেওয়া হলে পুরো এলাকার নারীদের প্রসূতিসেবা দেওয়া সম্ভব হবে। এখন সুলতানা বেগম অনেকটা একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন প্রসূতিসেবা।
মা সমাবেশ ও উঠান বৈঠক: প্রসূতিসেবার পাশাপাশি মায়েদের নিয়ে প্রতি সপ্তাহে তিন দিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মা সমাবেশ করেন সুলতানা। এ ছাড়া নিয়ে গ্রামে গ্রামে নারীদের নিয়ে উঠান বৈঠক করেন। এতে মা ও সন্তানের সঠিক পরিচর্যার পাশাপাশি পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করার জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। নারীদের জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি ও ইনজেকশন বিতরণ করেন। এতে জন্ম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিবার ছোট করার জন্য সুলতানা নারীদের পরামর্শ দিচ্ছেন। এ ছাড়া তাঁদের কর্মমুখী করতেও নিচ্ছেন নানা পদক্ষেপ।
সিকদারপাড়া এলাকার বাসিন্দা পারুল আকতার বলেন, ‘আমরা অনেক কিছুই জানতাম না। সুলতানা আপা আমাদের পথ দেখিয়েছেন। এখন নিজের শরীরের ও বাচ্চার খেয়াল রাখি নিজেই। তিনি আমাদের উপার্জনের অনেক উপায়ও বের করে দিয়েছেন।’
সেরার স্বীকৃতি: সুলতানা বেগম চকরিয়া উপজেলার কাকারা ইউনিয়নের মরহুম আকতার আহমদের মেয়ে। ১৯৮৫ সালে কাকারা উচ্চবিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন। পড়ালেখা বেশি দূর এগোয়নি। ছয় মাসের মাথায় বিয়ে হয় মাতারবাড়ীর বাসিন্দা ব্যবসায়ী কোহিনূর হোসেনের সঙ্গে। বিয়ের পর মাতারবাড়ী এসে দেখেন এখানকার নারীদের দুর্দশা। সন্তানের জন্মের সময় নিজেও অনেক সমস্যার মধ্যে পড়েন। তখনই নারীদের জন্য কিছু করার সংকল্প করেন। শেষে ১৯৯২ সালের ১ জুলাই পরিবার কল্যাণ সহকারী পদে যোগ দেন। এরপর ২০০৫ সালে প্রসূতিসেবার ওপর সরকারিভাবে ছয় মাসের দক্ষ ধাত্রীর (সিএসবিএ) প্রশিক্ষণ নেন। এরপর নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল থেকে আরও
তিন মাসের প্রশিক্ষণ নেন তিনি। প্রশিক্ষণ শেষে মাতারবাড়ীতে শুরু করেন প্রসূতিসেবার কার্যক্রম। দুই বছরের মাথায় ২০০৭ সালে সারা দেশে সেরা দক্ষ ধাত্রী নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ২০০৭, ২০০৯ ও ২০১১ সালে কক্সবাজার জেলার সেরা দক্ষ ধাত্রী হয়েছেন। আর ২০০৭ সাল থেকেই প্রতিবছর উপজেলার শ্রেষ্ঠ দক্ষ ধাত্রী হয়ে আসছেন।
মহেশখালী উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ছেরাজ আহমদ বলেন, মডেল হিসেবে ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর মাতারবাড়ী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে প্রসূতিসেবা চালু করা হয়। সফলতার সঙ্গে নারীদের প্রসূতিসেবা দেওয়ার জন্য কেন্দ্রটি জেলার শ্রেষ্ঠ পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলা থাকে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা। এর আগে সুলতানা বেগম বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রসূতিসেবা দিতেন। এখন কেন্দ্রেও দিচ্ছেন নিয়মিত সেবা।
মাতারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এনামুল হক চৌধুরী বলেন, সুলতানা বেগম মাতারবাড়ীর মানুষের ভরসাস্থল। তাঁর কাছে সেবা নিতে মাতারবাড়ীর পাশাপাশি ধলঘাট ইউনিয়নের নারীরাও ছুটে আসছেন। আর হাসিমুখে মায়েদের সেবা দিয়ে চলেছেন সুলতানা।